সেখ আকিজ উদ্দিন। খুলনার ফুলতলা উপজেলার পেছনে মধ্যডাঙ্গা গ্রামের এক নিতান্ত দরিদ্র পরিবারে ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শেখ মফিজ উদ্দিন। মা মতিনা বেগম। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আকিজ। অন্যান্য গ্রামের মতো সবুজ শ্যামল মধ্যডাঙ্গা গ্রামে আকিজ তার শৈশব উত্তীর্ন করেছেন। দারিদ্রের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে অভাব আর দুর্দিনে কেটেছে শৈশব। বাবা শেখ মফিজ উদ্দিন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। গ্রামের মৌসুমি ফসল কেনাবেচার ছোট ব্যবসা করতেন। দারিদ্রের কারণে আকিজ উদ্দিনের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে তিনি শিশুকালেই বাবার ব্যবসা পর্যবেক্ষণ করে আর দারিদ্রের সমুদ্রে সাঁতার কেটে ভেতরে ভেতরে সচেতন ও পরিনত হয়েছিলেন।
এক সংগ্রামী জীবন-চেতনার ভেতর দিয়ে উঠে আসা সাহসী পুরুষ :
মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে কিশোর আকিজ প্রিয় মধ্যডাঙ্গা গ্রাম ছেড়ে জীবিকার অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। হাতে মাত্র ১৬ টাকা নিয়ে দুরন্ত কিশোর চেপে বসেন ট্রেনে। অজানা পথের দিকে যেতে যেতে নিরন্তর খুঁজেছেন কোথায় এমন পথ যেখানে অভাব নেই। মানুষের নেই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান কিংবা চিকিৎসার অভাব। এক পর্যায়ে চলে আসেন কলকাতা। বড় শহর। কোথায় জায়গা মিলবে? কে তাকে আশ্রয় দেবে? শেষ পর্যন্ত আকিজ শেয়ালদহ রেলস্টেশনে তার ঠিকানা খুঁজে নেন। এখানেই অনিশ্চয়তার মধ্যে তার দিন যাপন। একবেলা ছাতু খেয়ে আকিজ কলকাতা শহরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নির্মাণ করেছেন। স্বপ্নের জাল বুনেছেন। কিন্তু তিনি কোনো অবলম্বন পাননি। এভাবেই কেটেছে কিছুদিন। তারপর শিয়ালদহের জাকারিয়া হোটেল মালিকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। হোটেলে তার আশ্রয় মেলে। কিশোর আকিজ পাইকারি বাজার থেকে কমলা লেবু কিনে হাওড়া ব্রীজে ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করলেন। সকাল সন্ধ্যা কমলা লেবুর ফেরিওয়ালা হয়ে পথে পথে ঘুরেছেন। ক্লান্ত আকিজ রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে কাগজ বিছিয়ে ঘুমিয়েছেন। কিন্তু তার ঘুম আসে না। তিনি কেবল স্বপ্ন বুনতে থাকেন। এরপর আকিজ কমলা লেবুর সামান্য জমানো টাকা দিয়ে একটি অভিনব মুদির দোকান দেন। ভ্যান গাড়ির ওপর সওদা। ভ্রাম্যমান এ দোকানের প্রতিটি দ্রব্যের দাম ছয় আনা। এ কারণে তিনি এ দোকানের নাম রাখেন ‘নিলামওয়ালা ছ’আনা’।
ভালোই চলছিলো তার দোকান। হঠাৎ একদিন অবৈধ দোকান দেয়ার অভিযোগে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায় তিন দিনের জেল পাঁচ টাকা জরিমানা। জেল থেকে মুক্ত হয়ে আকিজ আর দোকানে বসেননি। দোকানটি তিনি বিক্রি করে দেন। ফের অনিশ্চয়তা। এভাবে কিছুদিন কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি। খড়কুটা আকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। একদিন তার পরিচয় হয় পেশোয়ারের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। আকিজ ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে পেশোয়ার যান। অল্প দিনে পশতু ভাষা শিখে ফের অল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করেন ফলের ব্যবসা। দুই বছর এ ব্যবসা করে তার লাভ হয় ১০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে আকিজ বাড়ির টানে, বাবা মায়ের স্নেহ মমতার টানে ফিরে আসেন নিজ গ্রাম মধ্যডাঙ্গায়। বাড়ি ফেরার পর অল্পদিনের ব্যবধানে তার বাবা-মা মারা যান। আকিজ ফের নি:সঙ্গ হয়ে পড়েন। তারপরও সকল কষ্ঠবোধ-যন্ত্রণা-শোক থেকে আবার জীবনের দিকে সংগ্রামে পথে
বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য,অর্থনীতির কিংবদন্তী রূপকার সেখ আকিজ উদ্দিন :
১৯৫২ সালে আকিজ তার বন্ধুর বাবা ‘বিধু’ বিড়ির মালিক বিধু ভূষনের অনুগ্রহ-সহায়তা-পরামর্শে বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসাতে তিনি বেশ সফল হন। বেজেরডাঙ্গা রেল স্টেশনের পাশে তিনি একটি দোকান খুলে বসেন। কিন্তু আগুনে পুড়ে এক রাতে দোকানটি ছাই হয়ে যায়। মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু ধৈর্যশীল আকিজ ফের ঘুরে দাঁড়ান। তিনি স্থানীয় মহাজনদের সহায়তায় আবার দোকান নির্মাণ করেন। একই সঙ্গে শুরু করেন ধান, পাট, চাল, ডালের ব্যবসা। এক পর্যায়ে ব্যবসার প্রসারের জন্য আকিজ যশোরের নাভারন এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোজাহের বিশ্বাস আকিজকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। আকিজ আর পেছনে ফিরে তাকাননি। নাভারন পুরোনো বাজারে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আজকের সবচেয়ে বড় বিড়ি তৈরির কারখানা আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরী। এরপর ১৯৬০ সালে অভয়নগরে অত্যাধুনিক চামড়ার কারখানা এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ১৯৬৬ সালে ঢাকা টোবাকো ইন্ডাষ্ট্রিজ, ১৯৭৪ সালে আকিজ প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, ১৯৮০ সালে আকিজ ট্রান্সপোর্টিং এজেন্সি লিমিটেড, ১৯৮৬ সালে জেস ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, ১৯৯২ সালে আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিমিটেড, ১৯৯৪ সালে আকিজ জুট মিল লিমিটেড, ১৯৯৫ সালে আকিজ সিমেন্ট কেম্পানী লিমিটেড, একই বছর আকিজ টেক্সটাইল মিলস্ লিমিটেড, ১৯৯৬ সালে আকিজ পার্টিকল বোর্ড মিলস লিমিটেড, ১৯৯৭ সালে আকিজ হাউজিং লিমিটেড, ১৯৯৮ সালে সাভার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ২০০০ সালে আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেড, একই বছর আকিজ অনলাইন লিমিটেড, নেবুলা লিমিটেড, ২০০১ সালে আকিজ কর্পোরেশন লিমিটেড, আকিজ ইন্সটিটিউট এন্ড টেকনলজি লিমিটেড, ২০০৪ সালে আকিজ অ্যাগ্রো লিমিটেড এবং ২০০৫ সালে আকিজ পেপার মিলস্ প্রতিষ্ঠা করে তিনি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কিংবদন্তির নায়কে পরিনত হন।
একজন অনন্য সাধারণ সেখ আকিজ উদ্দিন :
কোটি কোটি টাকার অর্থ সম্পদের মালিক হয়েও সেখ আকিজ উদ্দিন খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি নিজের জীবন অভিজ্ঞতার আলোয় তিনি তাদের আলোকিত করেছেন। তার ১৫ সন্তানের মধ্যে ১০ ছেলে ৫ মেয়ে। বড় ছেলে ডা. শেখ মহিউদ্দিন আদ-দ্বীনের নির্বাহী পরিচালক। এছাড়া তার প্রত্যেক সন্তানেরাই সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি তার জীবন যাপনের বাস্তব জ্ঞানে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন। তার দুরদর্শিতার কারণেই আজ আকিজ গ্রুপ দেশের অন্যতম শিল্প গ্রুপ হিসেবে দেশে বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। এতকিছুর পরও তার মধ্যে কোনো আত্মঅহমিকাবোধ নেই। তিনি তার বিরুদ্ধের লোকদেরই আপন করে নিতেন। সব কিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। মানব কল্যাণে তিনি যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন হাসপাতাল। এছাড়াও বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকান্ডে মুক্ত হাতে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। ২০০০ সালে যশোরে ভয়াবহ বন্যায় আকিজ ত্রান নিয়ে ঢাকা থেকে ছুটে আসেন শার্শা-ঝিকরগাছা এলাকায়। এ সময় তিনি নিজে তদারকি করে প্রায় এক কোটি টাকার ত্রান সামগ্রী বিতরন করেছেন। আকিজ উদ্দিনের অন্যতম সৃষ্টি হচ্ছে আদ্ব-দীন ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ট্রাস্ট দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও আরও কিছু জেলায় মানব কল্যাণ, স্বাস্থ্য সেবা ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেছে। এছাড়া তিনি ১৯৮৯ সালে আদ্ব-দীন ওয়েল ফেয়ার সেন্টার, ২০০৪ সালে আদ্ব-দীন ফাউন্ডেশন, ১৯৮০ সালে আদ্ব-দীন শিশু কিশোর নিকেতন, ১৯৮৫ সালে আদ্ব-দীন নার্সিং ইন্সটিটিউট, আদ্ব-দীন ফোরকানিয়া প্রজেক্ট, ১৯৯২ সালে আকিজ কলেজিয়েট স্কুল, ১৯৯৮ সালে সখিনা স্কুল ফর গার্লস প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও তিনি অন্যান্য বিভিন্ন রকম সামাজিক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন।
১৬ টাকা থেকে হাজার কোটি টাকা আর কমলা লেবুর ফেরিওয়ালা থেকে ২২টি শিল্প ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের এমডি হয়েছেন সেখ আকিজ উদ্দিন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে পৃথিবীর পাঠশালা থেকে জ্ঞান অর্জন করে তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। ৫০ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ করে তিনি লাখ লাখ মানুষের ত্রানকর্তা হয়েছেন। ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে সেখ আকিজ উদ্দিনের আকিজ শিল্প গোষ্ঠি ৯৫০ কোটি টাকা শুল্ক কর সরকারকে প্রদান করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সমাজ জীবনে সেখ আকিজ উদ্দিনের অবদান অনস্বীকার্য। ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর ৭৭ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় তার জীবন অবসান ঘটে। তার সংগ্রাম-জীবন চেতনা-সাফল্য আমাদের প্রত্যেক উদ্যোক্তার জন্য উজ্জ্বল আদর্শ হয়ে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে।
এমন একজন আদর্শই একটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সব পথ খুলে দিতে পারে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস